× প্রচ্ছদ ঈশ্বরদী পাবনা জাতীয় রাজনীতি আন্তর্জাতিক শিক্ষাজ্ঞন বিনোদন খেলাধূলা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নির্বাচন কলাম
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঈশ্বরদী খেলা প্রযুক্তি বিনোদন শিক্ষা



হত্যাকাণ্ডের কলঙ্কময় ইতিহাস

হত্যা কখনো সমাধানের পথ নয়। হত্যা কখনো বিজয়ী করে না। হত্যা কখনো আদর্শ হতে পারে না। হত্যা করে আদর্শ নষ্ট করা যায় না। হত্যা একটি ঘৃণ্য ও চেতনাপরিপন্থী কর্মকাণ্ড। শোকাবহ আগস্ট। স্মৃতিভরা যন্ত্রণা। অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি একটি কলঙ্কময় ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী অফিসার বিশ্বাসঘাতকের হাতে নিহত হন। পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে ঘাতকরা হত্যা করে। যা আমার কাছে মনে হয় কলঙ্কময় ইতিহাস-কালো অধ্যায়। আজ এই শোকের মাসে সঙ্গত কারণেই নবীন প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- নিজের জীবনের চেয়েও দেশ আর দেশের মানুষকে যিনি ভালোবেসে ছিলেন, ফাঁসি নিশ্চিত জেনেও যিনি পাকিস্তানের কারাগারে বসে আপস করেননি স্বাধীনতার প্রশ্নে, যিনি বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বলেছিলেন, এ দেশের স্বাধীনতা আর জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক মুক্তির কথা, এ জাতি তারই উত্তরসূরি। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী মেধাবী নাম। ছোটবেলা থেকেই তার হৃদয়টা ছিল ভিন্নতর। মানুষকে ভালোবাসার ইতিহাসটা তার শৈশবকাল থেকেই। যদি দেশ বা স্বাধীনতার কথা বলি সেখানেও তার নামটি চিরস্মরণীয়। একজন দক্ষ চিকিৎসক মারা গেলে আমরা বলি জাতি একজন ভালো চিকিৎসককে হারাল। কিন্তু বর্ণাঢ্য এই রাজনৈতিক ও দেশপ্রেমিক মানুষটিকে হারিয়ে জাতি কি বলেছিল আমার জানা নেই। তবে আমার দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি সেদিন হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীন দেশকে। যার অভাব-অনুভূতি বয়ে বেড়াচ্ছে আজও। বিপক্ষ দলের কাছেও আজ বলতে শুনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক তারা। ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও ছিলেন অকুতোভয়, প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?- বাঙালি জাগরণের এই মহাজাদুকরের দৈহিক বিনাশ ঘটলেও তার আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না। হতে দেওয়া যায় না। আজ ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দলের পাল্লা ভারী। অনেকেই দলের পদ-পদবি পেতে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে পরিচয় দেয় বা দিতে পছন্দ করে। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রশ্নটা থেকেই যায়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ কেমন ছিল, রাজনীতিতে তার ত্যাগ কেমন ছিল তা কি আমরা লালন করছি? সময়টা ১৯৪০ সাল। শেখ মুজিব নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাকে গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪২ সাল এসএসসি পাস করেন। বঙ্গবন্ধু এই বছরেই পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ জানান। ২ মার্চ ভাষা প্রসঙ্গে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় গ্রেফতার হন। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে বঙ্গবন্ধুসহ গ্রেফতারকৃত ছাত্র নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু ১৫ মার্চ মুক্তি লাভ করেন। ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার কারণে গ্রেফতার হন। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং জেলে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু এ দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তি লাভ করেন। সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে গ্রেফতার হন ও পরে মুক্তি লাভ করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা মিছিল বের করে। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ১৪ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এবার তাকে প্রায় দুই বছর পাঁচ মাস জেলে আটক রাখা হয়। ১৯৫২ সাল। ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন ‘পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। এর প্রতিবাদে বন্দি থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এ দাবিতে জেলখানায় অনশন শুরু করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এক বিবৃতিতে ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। একটানা ১৭ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন। জেলখানা থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়ে তাকে ঢাকা জেলখানা থেকে ফরিদপুর জেলে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জের আসনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। ১৫ মে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। ৩০ মে বঙ্গবন্ধু করাচি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং গ্রেফতার হন। ২৩ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন। ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১ এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রসঙ্গ আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ৭ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।Advertisement
৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্। প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। তার এই ভাষণ বিশ্বের ইতিহাসে আজ বরণীয়। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। মূলত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। Advertisement
সকল ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়ে আসে ১৫ আগস্ট। মানুষ মরে যায়, আদর্শ মরে না। তাই বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তিমাত্র নন, অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নাম। শেখ মুজিবুর রহমান। লক্ষ্য বিজয়ী একটি নাম। একটি প্রতীক। একটি স্বাধীনতা, একটি বিজয়, একটি সফলতার গল্পের নায়ক। সেই প্রেরণাতেই এগিয়ে যাব আমরা। বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মানব মুক্তির দর্শনে বলীয়ান হয়ে গড়ব প্রাণের স্বদেশ। তার জন্মের সমুজ্জ্বল ইতিহাসটা সমৃদ্ধ হোক। নিপাত যাক সকল কালো অধ্যায়ের। বিনম্র শ্রদ্ধা মুজিব তোমারে। গোপাল অধিকারী : সাংবাদিক ও কলাম লেখক Copy by Khola kagoj

No comments