ত্রীর সঙ্গে অভিমান: ২৮ বছর পর ফিরলেন বাড়ি
বাচ্চু মণ্ডল বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-বন্ধুদের ফেলে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আমি সনাতন ধর্মের মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছি। এ ইউনিয়নে ৯৯ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা আমাকে তাদের ভাই হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছে। থাকতে দিয়েছে, ভালো খেতে দিয়েছে, ভালো ব্যবহার করেছে। কখনও অন্য ধর্মের মানুষ হিসেবে আমাকে ঘৃণা করেনি। আমি সুন্দলী ইউনিয়নবাসীর কাছে ঋণী।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বাচ্চু মণ্ডল স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি ছেড়েছিলেন ২৮ বছর আগে।
১৯৯৩ সালে যেদিন বাড়ি ছাড়েন, সেই দিনই বাসে করে আসেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নে। সেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাটিয়ে দিয়েছেন দীর্ঘ ২৮ বছর।
ইউনিয়নের কেউ বাচ্চু মণ্ডলের ঠিকানা না জানলেও ভালোবাসতেন সবাই। ডাকতেন বাচ্চু ভাই বলে। অবশেষে সন্ধান পেয়ে মান ভাঙিয়ে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন পরিবারের সদস্যরা।
সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিলের মধ্যস্থতায় মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে বাচ্চু মণ্ডলকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বাচ্চু মণ্ডল জানান, স্ত্রী জাহেদা বেগমের ওপর অভিমান করে ৩৬ বছর বয়সে তিনি বাড়ি ছাড়েন। বিভিন্ন যানবাহনে করে ওই দিনই যশোরের মণিহার সিনেমা হলের সামনে পৌঁছান। সেখান থেকে অভয়নগরের নওয়াপাড়া বাজার হয়ে সুন্দলী বাজারে পৌঁছালে রাত হয়ে যায়।
সেই রাতে ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের নগেন্দ্রনাথ রায় তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে খাওয়া-থাকার শর্তে নগেন্দ্রনাথের কৃষিজমি ও বাড়ির কাজ করতে শুরু করেন তিনি। তিন বছর পর একই ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মুকুন্দ মল্লিক তাকে তার বাড়িতে থাকার অনুরোধ করেন। সেখানে দুই বছর থাকার পর একই গ্রামের চারু মল্লিকের বাড়িতে চলে যান।
তিনি আরও জানান, ২০০৬ সালে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিকাশ মল্লিক ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে একটি ভ্যান উপহার দেন। সেই ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন তিনি।
পরে তাকে ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ওই সময় ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ শেখর বিশ্বাস তাকে থাকতে দেন।
২০১০ সালে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে বসবাসের সুযোগ দেন তৎকালীন চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা। সেই থেকে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদই তার বাড়ি।
বাচ্চু মণ্ডল বলেন, ‘আমার মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সেজ। স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-বন্ধুদের ফেলে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আমি সনাতন ধর্মের মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছি।
‘এ ইউনিয়নে ৯৯ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা আমাকে তাদের ভাই হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছে। থাকতে দিয়েছে, ভালো খেতে দিয়েছে, ভালো ব্যবহার করেছে। কখনও অন্য ধর্মের মানুষ হিসেবে আমাকে ঘৃণা করেনি। আমি সুন্দলী ইউনিয়নবাসীর কাছে ঋণী।’
বাড়ি ফিরলেও অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়নে সপরিবারে বেড়াতে আসবেন বলে জানান বাচ্চু মণ্ডল।
বাচ্চু মণ্ডলের ভাইপো শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চাচা নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা অনেক খুঁজেছি। একপর্যায়ে চাচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সম্প্রতি আমাদের এলাকার গ্রাম পুলিশ অসিত বিশ্বাসের মাধ্যমে চাচার সন্ধান মেলে। রাতেই চাচাকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েছি।’
তিনি জানান, স্ত্রী জাহেদা অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় বাচ্চু মণ্ডল বাড়ি ছাড়েন। বর্তমানে জাহিদুল ইসলাম নামে তার ২৭ বছরের একটি ছেলে আছে।
অন্য ধর্মের হলেও তার চাচার সঙ্গে সুন্দলী ইউনিয়নের মানুষের আচরণ সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বলেন, ‘বাচ্চু মণ্ডলের পরিবার আছে- এমন কথা তিনি কোনো দিন কাউকে বলেননি। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তিনি আমাদের ইউনিয়নে আছেন। ২০১০ সাল থেকে পরিষদের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে থাকতেন।
‘খুব ভালো মনের মানুষ তিনি। সবাই তাকে বাচ্চু ভাই বলে ডাকত। ২৮ বছর পর মানুষটিকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে আমরা তৃপ্ত।’
Advertisement (madimart)
Advertisement (sandha)
Advertisement (pabna sweet)
Advertisement (school)
No comments