কঠিন বার্তা দিল আওয়ামী লীগ
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত বা আপত্তিকর মন্তব্য বা কটাক্ষ সহ্য করবে না আওয়ামী লীগ। দলের গাজীপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করে এমন কঠিন বার্তাই দিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। এরপরই দেশের রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সর্বত্র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দলের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিষয়টি আলোচনার তুঙ্গে রয়েছে। দলের নেতাকর্মীসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গাজীপুরে একজন প্রভাবশালী নেতা জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ তৃণমূলসহ দেশবাসীকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আপসহীন মর্যাদা দেখিয়েছে। এই দুই বিষয়ে অমর্যাদাকর আচরণ করে কেউ কখনো পার পাবে না। রাজনৈতিকভাবে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি বার্তা হলো- বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগে কেউ অপরিহার্য নয়। এ থেকে তৃণমূলের নেতারা দলের শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে আরো সতর্ক থাকবেন। আওয়ামী লীগ করতে হলে দলের গঠনতন্ত্র, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি কখনো অবমাননা করা যাবে না। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা যাবে না। সেই সঙ্গে দলের কোন্দল ও অনিয়ম কখনো বরদাশত করা হবে না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, একটা রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটা ডিসিপ্লিন থাকে, আদর্শ থাকে। সেই আদর্শ থেকে যদি কেউ বিচ্যুত হয়, পার্টি তাকে শৃঙ্খলা ভঙের দায়ে শাস্তি দেবে। সেই শাস্তির মধ্যে সদস্যপদ বাতিল বা তাকে বহিষ্কার করতে পারে। এমন বিভিন্ন রকমের শাস্তি থাকে। গাজীপুরের মেয়রের বিষয়ে আমরা যে শাস্তি দেখলাম, তাতে আমার মনে হয়- একটি বার্তাই বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের দেয়া হলো, সেটা হচ্ছে- পার্টির শৃঙ্খলা, আদর্শ ও উদ্দেশ্য সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ; এই বিষয়ে কোনো ধরনের বিরূপ মন্তব্য-বক্তব্য বা বিবৃতি কোনোভাবেই কাম্য নয়, কাক্সিক্ষত নয়। দেশবাসীও সেটা পছন্দ করে না। সেদিক থেকে আমার মনে হয়, এই বার্তাটি আওয়ামী লীগ দেশবাসীকে দিতে চেয়েছে।
এদিকে জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও বুঝতে পেরেছেন দলের জন্য কেউ অপরিহার্য নয়। দলের পরিচয়েই সবার পরিচয়। দলের সুনাম ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। অন্যতায় দল কাউকেই ছাড় দেবে না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, তৃণমূলে বার্তা একটাই। সেটা হলো একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগে আর কেউ অপরিহার্য নেই। এটা কারো ভাবারও কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত; দলের নীতিমালা-শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে কথা বলার সুযোগ কারো নেই। বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে কোনো বিতর্কিত কথা বলা আওয়ামী লীগের হৃৎপিণ্ডে আঘাত করার শামিল। এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের হৃৎপিণ্ডে আঘাত করার শামিল। সেই আঘাত যে করবে, দলীয় শৃঙ্খলা যে ভাঙবে তার জন্য একটা অশনি সংকেত বা বিশেষ সতর্কতার সিগন্যাল।
এদিকে আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ গতকাল বলেন, এর মাধ্যমে কিছু বার্তা দেয়া হয়েছে। জাতির পিতা ও আওয়ামী লীগ- এ দুয়ের ব্যাপারে আমরা কারো সঙ্গে কোনো আপস করব না। পাশাপাশি দলের শৃঙ্খলা ভঙের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো মতে ছাড় দেয়া হবে না। যার যত কাছের মানুষ, যার যত প্রিয় মানুষ হোক না কেন, সেটা দেখার বিষয় নয়। মাঠে এটাই বার্তা যাবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র এবং একটি মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর যখন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত কথা বলে, তখন স্বাধীনতাবিরোধীরা উৎসাহিত হয়। তার বক্তব্য জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। ওই অপশক্তিকে উৎসাহিত করেছে। তাদের সমর্থন দিয়েছে। তার বক্তব্য আমাদের আঘাত করেছে। সুতরাং তাকে সারাজীবনের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সে আওয়ামী লীগের মেয়র হিসেবে থাকতে পারবে না। জাতির কাছে বার্তা হলো, আওয়ামী লীগের যে সুনির্দিষ্ট আদর্শ গণমানুষের মুক্তি। এ দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষের বাংলাদেশ। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত বাংলাদেশ। ঠিক এ সময় এ ধরনের ষড়যন্ত্রে যারাই লিপ্ত হবে, আমাদের দলে থেকে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উৎসাহিত করে, ইন্ধন জোগায়, তারা যেই হোক- দলে তাদের প্রয়োজন নেই।
আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, দলের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা ব্যতীত কেউ অপরিহার্য নয়। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়- সেই বাণী পুনরায় উচ্চারিত হলো। দলের নীতি, আদর্শ ও জনবিরোধী কাজ করে যত শক্তিশালীই হোন কেউ ছাড় পাবেন না।
আগের দিন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় জাহাঙ্গীরকে নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তি করে জাহাঙ্গীর চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। আমাদের হৃৎপিণ্ডে আঘাত হেনেছে। তাকে কঠিনতম শাস্তি দিতে হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যাতে আর কেউ জাতির পিতাকে নিয়ে কটাক্ষ করার সাহস না দেখায়। এরা নীতি ও আদর্শহীন। এদের এখনই কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। এই দানব ও মানবতার শত্রæদের বিরুদ্ধে নেত্রী আপনাকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাকে মহানগর সাধারণ সম্পাদক পদসহ প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে চিরতরে বহিষ্কার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাসও একই দাবি করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, জাহাঙ্গীর ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। শুধু দলীয়ভাবে শাস্তি দিলেই হবে না। আইনগত ব্যবস্থাও নিতে হবে। তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, জাহাঙ্গীরের বক্তব্য সংবিধান লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রদ্রোহী। জাতির পিতাকে কটাক্ষ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করার বিধান আছে। উপস্থিত নেতারা দলীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার মতামত দেন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য জানতে চান দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। জবাবে তিনিও সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হন। সেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। এরপর আওয়ামী লীগ সভাপতি দলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেন, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলো। একই সঙ্গে তার প্রাথমিক সদস্যপদও চিরতরে বাতিল করা হলো।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার রাতে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Advertisement (madimart)
Advertisement (sandha)
Advertisement (pabna sweet)
Advertisement (school)
No comments