চলতি বছরই সর্বজনীন পেনশন
চলতি বছরের মধ্যেই চালু হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি নাগরিকদের জন্য এ ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। প্রবাসীরাও এই সুবিধা পাবেন। প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে। পরবর্তীতে এটাকে পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলক করা হবে।
গতকাল বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ও অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশের অনেক অর্জন, সেই অর্জনের সঙ্গে আজকে যুক্ত হলো আরো একটি অর্জন। সেটা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। এই পেনশন ব্যবস্থা সবার জন্য।
দেশের ৫ সহস্রাধিক অর্থনীতিবিদের সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দাবি, সর্বজনীন পেনশন বিষয় নিয়ে এখনই ভাবনা জরুরি। দেশের ষাটোর্ধ্ব সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে কার্যকর পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ নিয়ে সরকার কার্যকর কী কী পদক্ষেপের কথা ভাবছে তার সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা, বিবরণী ও সার্বিক পরিকল্পনা থাকতে হবে বাজেটে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, বাধ্যর্কজনিত কারণে অভাবগ্রস্তদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই সাহায্য লাভের অধিকার রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বাধ্যর্কজনিত কারণে যে সমস্ত অভাব আসতে পারে বা আসে জীবনে, সে সমস্ত অভাবগ্রস্ত নাগরিকরা পেনশন পাবে।
তিনি আরো বলেন, ২০০৮ সালে নির্বাচনি ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বয়স্কদের টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় মৃত্যুকালীন সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটে আনা হয়েছিল যে, এটা আমরা বাস্তবায়ন করবো। তার ধারাবাহিকতায় এখন এটা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। এটা বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রত্যেকটি মানুষ লাভবান হবে।
তিনি জানান, পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আরো বিস্তারিত জানানো হবে। এখানে কিছু সংযোজন বিয়োজন আরো অনেক জায়গায় হবে। কিন্তু আমাদের মৌলিক ধারণাগুলো এখন তুলে ধরা হচ্ছে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি সব নাগরিক সর্বজনিত পেনশন ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরাও এ ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিষয়টি আমরা পরে বিবেচনা করবো। জাতীয় পরিচয়পত্রের ওপর ভিত্তি করে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত সব নাগরিক পেনশনের হিসাব খুলতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে। পরবর্তীতে এটাকে পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলক করা হবে।
কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদাদানের মাধ্যমে মাসিক পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পেনশন অ্যাকাউন্ট থাকবে। ফলে চাকরি পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। মাসিক সর্বনিন্ম চাঁদা নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দিতে পারবেন। চাঁদা জমা দিতে ব্যর্থ হলে হিসাব সাময়িক বন্ধ থাকবে। পরবর্তীতে জরিমানাসহ বকেয়া দিয়ে হিসাব চালু করতে পারবেন। পেনশনের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ৬০ বছর পূর্তিতে নির্ধারিত হারে তহবিল থেকে আসবে। পেনশনধারীরা আজীবন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। নির্ধারিত চাঁদা দানকারী ৭৫ বছর হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে জমাকারীর নমিনি পেনশন পাবেন ৭৫ বছর পর্যন্ত।
এই পেনশন ব্যবস্থায় জমাকারীর অবর্তমানে এককালীন টাকা তোলার কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের প্রেক্ষিতে পেনশনের ৫০ ভাগ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে। কোনো জমাকারী ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পর যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে জমাকৃত অর্থ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা পরে আলোচনা করে নির্ধারণ করা হবে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। কর্তৃপক্ষ বাজেটে নির্ধারিত টাকা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যয় করবেন। এভাবেই প্রস্তাবনা করা হয়েছে। আরো প্রস্তাবনা এলে এবং সেটা বিবেচিত হবে। শেষ বয়সে যখন কেউ দেখার থাকবে না তখন এই পেনশন ব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কবে থেকে চালু হবে জানতে চাইলে মুস্তফা কামাল বলেন, আশা করি, আগামী ৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে চালু হবে। পাইলট বেসিসে হবে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, পাইলট না, এখন আমরা সবার মতামত নিয়ে বিধিমালা, আইন একসঙ্গেই প্রণয়ন করবো এবং বাস্তবায়নে যাব। এরপর যদি প্রয়োজন হয় বাস্তবায়ন চলাকালীন সময়ে সেটা তখন দেখা যাবে।
জানা গেছে, সর্বজনীন যে পেনশন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে তাতে মাসে এক হাজার টাকা জমা করলে ৬০ বছর থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত ২০ বছর প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাওয়া যাবে। এই পরিমাণ পেনশন পেতে সেই ব্যক্তিকে ১৮ বছর বয়স থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে এই চাঁদা জমা দিতে হবে। বার্ষিক ১০ শতাংশ মুনাফা ও আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরে এই হিসাব করা হয়েছে।
কেউ ৮০ বছরের বেশি বেঁচে থাকলে তার ক্ষেত্রে হিসাবটা কত হবে, সেটি এখনো জানানো হয়নি। তবে তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, ততদিনই পেনশন পাবেন। আর এই ৮০ বছর ধরা হয়েছে গড় আয়ুর হিসাব কষে। বর্তমানে দেশে গড় আয়ু ৭৩ বছর। ২০৭৫ সালে এটি ৮৫ হবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। কেউ ৭৫ বছর বয়সের আগে মারা গেলে জমাকারীর বছর ৭৫ হওয়া পর্যন্ত তার নমিনি পাবেন এই পেনশন।
এই পদ্ধতিতে পেনশন পেতে আগ্রহীদেরকে প্রতি মাসে টাকা জমা করতে হবে। বেশি বছর ধরে টাকা জমা করলে পেনশনের পরিমাণ বেশি হবে। একজনকে সর্বনিম্ন ১০ বছর টাকা জমা করতে হবে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি সকল কর্মক্ষম নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারবে; জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে নাগরিকরা পেনশন হিসাব খুলবেন। প্রথমে এটি স্বেচ্ছাধীন থাকলেও পরে বাধ্যতামূলক করা হবে। ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন হবে।
কেউ যদি ৩০ বছর বয়সে টাকা জমানো শুরু করেন, এবং তিনি যদি মাসে এক হাজার টাকা জমান, তাহলে তার পেনশন কমে হবে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা। কেউ চাইলে এর চেয়ে বেশি চাঁদা জমা করতে পারবেন। এটি একটি আনুমানিক হিসাব। প্রকৃত অবস্থা আইন ও বিধি প্রণয়ন এবং পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার পর বিস্তারিত জানা যাবে।
তবে যাদের পক্ষে এই পরিমাণ অর্থ জমানো সম্ভব হবে না, তাদেরকে আর্থিক সহায়তা করবে সরকার নিজেই। পেনশন স্কিমে টাকা জমার হার নির্দিষ্ট নয়। কেউ তার সর্ঙ্গ্যে অনুযায়ী টাকা জমা করবে। নিম্ন আয়সীমা নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের যে খরচ হবে, সেটি বহন করবে সরকার।
সবার জন্য পেনশন আওয়ামী লীগের গত আমলের চিন্তা। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এ জন্য পাইলট প্রকল্পের কথা বলেছিলেন তিনি। সর্বজনীন পেনশনকে মুহিত তার স্বপ্নের প্রকল্প উল্লেখ করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কাজ চলেনি।
তবে সরকারের নানা কাজ যে পর্দার আড়ালে হয়েছে, সে বিষয়টি স্পষ্ট হলো গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন’ বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেয় অর্থ বিভাগ। এরপর প্রধানমন্ত্রী ষাটোর্ধ্ব জনগণের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়ন এবং কর্তৃপক্ষ স্থাপনের নির্দেশ দেন। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে আইন করার উদ্যোগ নিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দেন তিনি।
পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন প্রদেয় হবে। পেনশন স্কিমে জমা অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে তোলা যাবে, যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে।
সূত্র: বাংলাদেশের খবর
Advertisement (sandha)
Advertisement (pabna sweet)
Advertisement (school)
No comments