সীতাকুণ্ডের আগুন কেন এত ভয়াবহ হলো?
সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনের ভয়াবহতা জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্নের। কী কারণে এত ভয়াবহ হলো এই আগুন? কেন নিয়ন্ত্রণ করা গেল না সহজে? কী ছিল এসব কনটেইনারে? ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য পদার্থের বিষয়টি কি ডিপো কর্তৃপক্ষ অবগত ছিল? কী প্রস্তুতি ছিল দুর্ঘটনা মোকাবিলায়? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না কেউ। যা কিছু জানা যাচ্ছে, তার পুরোটাই ধারণানির্ভর।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা জানতে পারেননি কোন কনটেইনারে কী আছে। কেউ তাদের এ ব্যাপারে জানায়ওনি। কোন কনটেইনারে দাহ্য পদার্থ আছে জানা গেলে তারা এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারতেন।
অন্যদিকে ডিপো কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় তাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো পদার্থ আমদানির বিষয়েও তারা অবগত ছিলেন না। যদিও তাদের এই দাবিকে ঘিরে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের নজর ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এ ধরনের পদার্থ ডিপোতে রাখা হলো? এই দায় কি তারা চাইলেই এড়াতে পারেন?
কী কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বা এত ক্ষয়ক্ষতির কারণইবা কী? এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এখানে ডিপো কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা অস্বীকার করা যাবে না। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের নয়জন সদস্যের প্রাণহানির বিষয়টিও আতঙ্কের কারণ।
ঢাকা টাইমসের সঙ্গে কথা হয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বাহিনীর সাবেক পরিচালক ও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজের। তিনি বলেন, ‘গোখরা শাপ নিয়ে খেলার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে এটি যেকোনো সময় ছোবল দিতে পারে। যারা আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত হয়েছেন, তারা হয়তো ধারণা করতে পারেননি এত বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১১ সালে এই ডিপোর কার্যক্রম চালু হয়। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়টি অবশ্যই আরও আগে দেখা দরকার ছিল। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা জানে না হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড এসেছে। অথচ এই পদার্থ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরিতে কাজে লাগে। যেমন- মাউথ ওয়াশ, নেইল রিমুভার, কিচেন ক্লিন, কাপড় পরিষ্কার ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে তাদের অনুমোদন ছিল না। তাহলে কীভাবে এল এগুলো?’
আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত প্রাণহানির শিকার কর্মীরা এখানে কেমিক্যাল সম্পর্কে অবগত ছিলেন কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন রেখে শাকিল নেওয়াজ বলেন, কারণ এই ধরনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দূরত্ব রক্ষা করে কাজ করতে হয়। ১০০ মিটারকে বলা হয় হট জোন। ৩০০ মিটারকে বলা হয় ওয়ার্ম জোন। তারপরের অংশ হচ্ছে কুল জোন।
হট জোনে একমাত্র কেমিক্যাল এক্সপার্ট লোক ঢুকবে। ওয়ার্ম জোনে ফায়ার ফাইটার, অ্যাম্বুলেন্স তারা তৈরি থাকবে। আর কুল জোনে সাধারণ মানুষ থাকবে। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় এই শৃঙ্খলা মানা হয়েছে কি না, সেটি দেখার বিষয়। বলেন মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজের।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রাণহানির ঘটনা দুঃখজনক উল্লেখ করে সংস্থাটির এই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ডিপোর আগুনে যে ধরনের সতর্কতা দরকার ছিল বা যে ধরনের ইকুইপমেন্ট সাপোর্ট দরকার ছিল, তা ছিল কি না, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। সেসব যথাযথ থাকলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের এত প্রাণহানি হয়তো ঘটত না।‘
ডিপোর স্টোরিং ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক বলেন, ‘ডিপোতে কনটেইনারগুলো স্টোরিংয়ে বড় ঘাটতি ছিল। কেমিক্যাল সব সময় আলাদা জায়গায় রাখতে হয়। একটি কনটেইনার থেকে আরেকটি কনটেইনারের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বও থাকতে হবে। যাতে একটি বিস্ফোরণ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ ধরনের কেমিক্যাল হালকা ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় রাখতে হয়।’
কী কারণে এই আগুন লাগতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘তিন কারণে আগুন লাগতে পারে। একটি হলো প্রাকৃতিক আগুন। অর্থাৎ বজ্রপাত থেকে। দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনাবশত আগুন লাগতে পারে। যেমন- মানুষের অসতর্ক চলাফেরা, বৈদ্যুতিক ত্রুটি, ধূমপান, গ্রেইনডিং, ওয়েল্ডিং ইত্যাদি। তৃতীয়ত, শত্রুতা করে বা পরিকল্পনা করে কেউ আগুন দিলে। যেহেতু শনিবার রাতে সেখানে কোনো বজ্রপাত হয়নি তাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় কারণ দুটো অনুসন্ধান করতে হবে।’
শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে একটি দাহ্য পদার্থের কনটেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। স্থানীয়রা জানান, বিস্ফোরণে ডিপো এলাকার পাঁচ কিলোমিটার প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
রবিবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সীতাকুণ্ড আগুনে মৃতের সংখ্যা ৪৯ স্পর্শ করেছে। এর মধ্যে নয়জন আছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। আহত হয়েছেন দেড় শর বেশি মানুষ। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিএমএইচে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কয়েকজনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
Advertisement (sandha)
Advertisement (pabna sweet)
Advertisement (school)
No comments